বিশ্বকোষ
ভূমিকা :
বিশ্বকোষ হলো কোনো গ্রন্থ বা গ্রন্থমালা , যেখানে জ্ঞানের সকল শাখার নানাবিধ বিষয়ে লেখা সংকলিত থাকে । লেখাগুলো নিবন্ধ আকারে সংশ্লিষ্ট ভাষার বর্ণানুক্রমে কিংবা বিষয় অনুযায়ী সজ্জিত থাকে । পৃথিবীর সকল জ্ঞানশাখা বা শৃঙ্খলার বিষয়াবলি এতে স্থান পায় । তবে এমন বিশ্বকোষও রয়েছে যাতে একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানশাখার বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত নিবন্ধ সজ্জিত থাকে । যেমন – আইনকোষ , অর্থনীতিকোষ ইত্যাদি । বাংলায় বিশ্বকোষ শব্দটি ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়া শব্দের প্রতিশব্দ । একটি বিশ্বকোষ সংকলনে যুক্ত থাকেন নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ । তাঁদের রচিত নিবন্ধগুলো তাই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হয় । বিশ্বকোষে সংকলিত নিবন্ধগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও সেগুলো একেকটি বিষয়ের উপর গভীর ধারণা দেয় । বর্তমানে বিশ্বকোষের মুদ্রিত রূপ ছাড়াও কম্পিউটারে ব্যবহারযোগ্য রূপও পাওয়া যায় ।
বিশ্বকোষের বৈশিষ্ট্য :
প্রতিটি বিশ্বকোষের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে । প্রথমত , বিশ্বকোষে অন্তর্ভুক্ত ভুক্তিগুলো সুবিন্যস্ত হতে হয় , যাতে পাঠক দ্রুত এবং অল্প আয়াসে কোনো বিষয়ের তথ্য খুঁজে পায় । দ্বিতীয়ত , বিভিন্ন বিষয় সন্নিবেশের কারণে এটি আয়তনে বৃহৎ হয়ে থাকে । কখনো অনেকগুলো খণ্ডে প্রকাশিত হয় । এটি কোষগ্রন্থসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো । তৃতীয়ত , বিশ্বকোষের তথ্যাদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করতে হয় । কারণ , নির্ভরযোগ্যতা বিশ্বকোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । চতুর্থত , পরিবর্তিত তথ্যের আলোকে বিশ্বকোষকে নিয়মিত হালনাগাদ করতে হয় । তাই বিশ্বকোষের কাজকে কখনো সমাপ্ত বলে ভাবা যায় না ।
বিশ্বকোষের প্রকারভেদ :
বেশ কয়েক রকমের বিশ্বকোষ দেখা যায় । বিষয়ের ব্যাপকতার ভিত্তিতে বিশ্বকোষ দুই ধরনের : ১. সাধারণ বিশ্বকোষ । ২. বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ । প্রকাশের মাধ্যম বিবেচনায় বিশ্বকোষ দুই ধরনের : ১. মুদ্রিত ও ২. ডিজিটাল । প্রতিষ্ঠানের অধীনে নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ছাড়াও এক ধরনের বিশ্বকোষ রয়েছে যা স্বেচ্ছাসেবী লেখকরা সংকলন করেন । নিচে কয়েক ধরনের বিশ্বকোষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
ক . সাধারণ বিশ্বকোষ : এ ধরনের বিশ্বকোষে বিষয়ের ব্যাপকতা দেখা যায় । সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ এই বিশ্বকোষের ভুক্তিতে কাজ করেন । তাঁদের লেখা নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের মাধ্যমে একেকটি বিষয়ের আলোচনা বা তথ্য তুলে ধরা হয় । ' এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ’ এ ধরনের বিশ্বকোষ।
খ . বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ : কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সাধারণ বিশ্বকোষে প্রদত্ত বর্ণনা ছাড়াও আরো গভীর ধারণা পেতে বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষ ব্যবহার করতে হয় । বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষগুলো কেবল ওই বিষয়সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে । ' আইনকোষ ' , ' এনসাইক্লোপিডিয়া অব ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিঙ্গুইস্টিকস ' এ ধরনের বিশ্বকোষ।
গ . বৈদ্যুতিন বিশ্বকোষ বা ডিজিটাল বিশ্বকোষ : প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে অনেকেই মুদ্রিত বিশ্বকোষের পরিবর্তে কম্পিউটার বা মুঠোফোনে বিশ্বকোষ ব্যবহার করছে । এগুলোকে বৈদ্যুতিন বা ডিজিটাল বিশ্বকোষ বলা হয় । এ ধরনের বিশ্বকোষ হালনাগাদ রাখা সহজ।
ঘ . স্বেচ্ছাসেবী লেখকদের বিশ্বকোষ : ইনটারনেটে কিছু বিশ্বকোষ রয়েছে যা স্বেচ্ছাশ্রমে সংকলিত হয় । পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে স্বেচ্ছাসেবী লেখকগণ অনলাইনে বিশ্বকোষকে সমৃদ্ধ করেন । ‘ উইকিপিডিয়া ’ এ ধরনের বিশ্বকোষ।
বিশ্বকোষের ভুক্তি :
বিশ্বকোষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত থাকে । এগুলোকে বলা হয় ভুক্তি । অভিধানের চেয়ে বিশ্বকোষের ভুক্তি আলাদা হয়ে থাকে । সাধারণ অভিধানে একটি শব্দের ব্যুৎপত্তি , উচ্চারণ , সংজ্ঞা , বাক্যে প্রয়োগ ইত্যাদি থাকে । কিন্তু বিশ্বকোষের ভুক্তিগুলো হয় দীর্ঘ । বর্ণনা এবং ভাবগত বিবেচনায় এর ব্যাপ্তি অভিধানের চেয়ে বেশি । বিষয়ের শিরোনাম সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে রচিত নিবন্ধই বিশ্বকোষের ভুক্তি । ভুক্তির মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী মানচিত্র , সারণি , ছবি , পরিসংখ্যান কিংবা গ্রন্থপঞ্জিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । অধিকাংশ বিশ্বকোষে ভুক্তি রচয়িতার নাম ভুক্তির নিচে সংযুক্ত থাকে । ভুক্তির মধ্যে কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয় । এর অর্থ , এই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে আলাদা ভুক্তি রয়েছে । পাঠক প্রয়োজনে সেসব ভুক্তি পাঠ করে নির্দিষ্ট বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নিতে পারেন । অনলাইন বিশ্বকোষে এগুলো আলাদা রঙের হয় এবং তাতে ক্লিক করলে সেই বিষয়ের আলোচনা সামনে চলে আসে ।
পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু বিশ্বকোষ :
প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বিশ্বকোষের চর্চা হচ্ছে । তবে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকজন ফরাসি পণ্ডিত Encyclopedia নামে গ্রন্থমালা প্রকাশ করেন । পৃথিবীময় যে জ্ঞান রয়েছে তা সংগ্রহ ও সুবিন্যস্ত করে সমকালীন পাঠক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌছে দেওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল । এর পর ১৭৬৮–১৭৭১ সালে ইংরেজি বিশ্বকোষ ‘ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ' প্রকাশিত হয় । এটি এখন ৩২ খণ্ডের মুদ্রিত বইয়ে এবং অনলাইনে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় । এছাড়া ' এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা ’ , ‘ কলিয়ার্স এনসাইক্লোপিডিয়া ’ , ‘ চেম্বার্স এনসাইক্লোপিডিয়া ’ , ‘ এভরিম্যানস এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি বিশ্বকোষ অনুসন্ধানী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে ।
বাংলা ভাষায় রচিত বিশ্বকোষ:
বাংলা ভাষায় জ্ঞানকোষ রচনার প্রথম পদক্ষেপ নেন উইলিয়াম কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি । তিনি ‘ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অবলম্বনে ' বিদ্যাহারাবলী ' নামক জ্ঞানকোষ রচনার কাজ শুরু করেন । তবে বাংলা ভাষায় যথার্থ বিশ্বকোষ হলো নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত ‘ বিশ্বকোষ ' । এর প্রথম খণ্ড সংকলন করেন রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় । দ্বিতীয় খণ্ড থেকে ২২ তম খণ্ড পর্যন্ত সংকলন করেন নগেন্দ্রনাথ বসু । এই বিশ্বকোষের কাজ শুরু হয় ১৮৮৬ সালে এবং শেষ হয় ১৯১১ সালে । এছাড়া ' ভারতকোষ ' বাংলা ভাষায় সংকলিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশ্বকোষ । এটি ১৮৮১ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে রাজকৃষ্ণ রায় ও শরচ্চন্দ্র দেব কর্তৃক সংকলিত হয় ।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিশ্বকোষ - জাতীয় গ্রন্থসমূহের মধ্যে ' বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান বিশ্বকোষ ’ - এর নাম উল্লেখযোগ্য । আয়তন , ভুক্তিসমূহের বিন্যাস ও ব্যবহার যোগ্যতার বিবেচনায় এটি একটি সফল প্রয়াস বলা যায় । নওরোজ কিতাবিস্তান ও মুক্তধারা প্রকাশিত চার খণ্ডে সংকলিত ‘ বাংলা বিশ্বকোষ ' ( ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ ) একটি সুপরিকল্পিত বিশ্বকোষ , যদিও এটি ‘ কলাম্বিয়া ভাইকিং ডেস্ক এনসাইক্লোপিডিয়া ' অবলম্বনে রচিত । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আরো কিছু বাংলা কোষগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে । তবে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘ বাংলাপিডিয়া ’ বাংলাদেশে বিশ্বকোষ চর্চায় এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ । ' বাংলাপিডিয়া ’ বর্তমানে ১৪ খণ্ডে পাওয়া যায় । এর কম্পিউটারে ব্যবহারের সংস্করণ এবং অনলাইন সংস্করণও রয়েছে।
উপসংহার:
বিশ্বের সব শৃঙ্খলার ধারণাসমূহ কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয় । এমনকি একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানশাখার সব বিষয়ও কারো একার পক্ষে জানা সম্ভব নয় । প্রত্যেকের লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে এক জায়গায় বিন্যস্ত করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বিশ্বকোষের প্রধান লক্ষ্য । কোষগ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশ্বকোষ শুধু আয়তনেই বড়ো নয় , জ্ঞানচর্চার এক বিপুল ভান্ডারও বটে । তাই প্রতিটি ভাষায় বিশ্বকোষ থাকা জরুরি ।