দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনজীবন
ভূমিকা :
বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের জন্যে অপরিহার্য প্রয়োজন হলো খাদ্য , বস্ত্র , শিক্ষা , বাসস্থান ও চিকিৎসা । এর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন সর্বাগ্রে । কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশেষত খাদ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে দেশে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে । অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্যসামগ্রী সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন অনাহারের দ্বারপ্রান্তে । আমাদের দেশেও চাল , ডাল , তেল , লবণ , মরিচ , পেঁয়াজ , রসুন , তরকারি , দুধ , চিনি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে করে তুলেছে অচল ও আড়ষ্ট , বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে লাগামহীন এ মূল্যবৃদ্ধি অভিশাপস্বরূপ ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাম্প্রতিক চিত্র :
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ক্রমাগতই বাড়ছে । ন্যায়সঙ্গত ও নির্ধারিত মূল্য বলতে এখন আর কিছুই নেই । ২০০১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যদি আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব , কী অভাবনীয় হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে । অন্যান্য দ্রব্যের হিসাব বাদ দিয়ে আমরা যদি কেবল চালের মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করি তাহলে দেখব , ২০০১ সালে যে চালের দাম ছিল ১৭ টাকা ২০২২ সালে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি হয়ে সে চালের দাম হয়েছে ন্যূনতম ৫৫-৬০ টাকা বা তারও বেশি । বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর শিয়েন জু'র মতে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ শতাংশ , একইভাবে ভোজ্যতেল ৩২ টাকা থেকে ২০০ টাকা , মসুর ডাল ৩৫ থেকে ১০০ টাকা , আটা ১২ থেকে ৫৫ টাকা , গরুর মাংস ৭০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা , কাঁচামরিচ ৪০ থেকে ১০০ টাকায় বৃদ্ধি পায় । অন্যান্য দ্রব্যেরও মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে অভাবনীয় হারে । বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি এতই অনিয়ন্ত্রিত যে এখন প্রতিমাসে এমনকি প্রতিসপ্তাহে মূল্য বেড়ে চলেছে । এতে জনসাধারণের জীবনযাপন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ । আমাদের দেশে এ পরিমাণ বৃদ্ধি মূল্যে এক কেজি চাল কিনে জীবন চালানোর সামর্থ্য অনেকেরই নেই । একই সাথে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস , পানি ও বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় জনজীবন হয়ে পড়েছে অসহায় ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বর্তমানে একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে । নানান কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে । যেমন-
- চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি । ক্রেতার চাহিদানুযায়ী সরবরাহ না থাকায় অনিবার্যভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
- অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত : স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী মহল মজুতদারির মাধ্যমে বাজারে আকস্মিক কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় । হঠাৎ করে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে গায়েব করে ফেলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে ক্রেতার চাহিদা বেড়ে গেলে বেশি মূল্যে বাজারে ছাড়ে।
- বৈদেশিক রপ্তানি : বিদেশে যেসব পণ্য রপ্তানি করে বেশি লাভ হয় রপ্তানিকারকেরা সেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে । এতে করে দেশে পণ্য ঘাটতি ঘটে এবং মূল্য বৃদ্ধি পায়।
- করবৃদ্ধি : অনেক সময় সরকার তার দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন চালানোর স্বার্থে কিংবা দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে জনগণের ওপরে অধিক করারোপ করে । এ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায়।
- চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি : আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদক এবং ভোক্তার মাঝে অসংখ্য স্তরে চাঁদাবাজরা সক্রিয় থাকে এবং তাদের চাঁদা দিতে দিতে পণ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যায় । এরা সাধারণত পরিবহন সেক্টর এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদা আদায় করে । যার প্রভাব পড়ে পণ্যদ্রব্যের ওপর।
- সংরক্ষণ , সরবরাহ ও বণ্টনে অব্যবস্থা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট হরতাল , ধর্মঘট , অবরোধ ইত্যাদির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় । এসব ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বাজারে দ্রব্য সরবরাহ কমে যায় , ফলে মূল্য বৃদ্ধি পায় । এর ওপর পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও বণ্টনে অব্যবস্থার ফলেও মূল্যবৃদ্ধির কবলে পড়তে হয়।
- বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি : বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা । উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত এ সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায় নি । ফলশ্রুতিতে আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য বাড়ছে । তবে আফসোস , এ বিশ্ববাজারে অনেক সময় দ্রব্যের মূল্য কমে এলেও আমাদের দেশে মূল্যহ্রাসের কোনো প্রভাব পড়ে না।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি : অধিক জনসংখ্যা আমাদের দেশের একটা অন্যতম বৃহৎ সমস্যা । বাড়তি জনসংখ্যার জন্যে প্রয়োজন বাড়তি পণ্যের ব্যবস্থা করা । কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হয় না বলে বাজারে পণ্যঘাটতির সৃষ্টি হয় । এতে করে মূল্য বেড়ে যায়।
- চোরাচালান : কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় দেশিয় পণ্য চোরাপথে বিদেশে পাচার করে দেয় । এতে করে দেশে ঐসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ : ঝড় , বন্যা , জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশের প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । এ ধরনের দুর্যোগ নষ্ট করে দেয় অনেক খাদ্যপণ্য । ফলে খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি সৃষ্টি হয় । আবার দুর্যোগের ফলে অনেক সময় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । এমতাবস্থায়ও পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হয় বলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের ওপর যে শুল্কভার আরোপ করা হয় , তাতেও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় । এতে দুর্ভোগ বাড়ে জনগণের । কেননা পণ্যের ওপর যে করারোপ করা হয় তা প্রকারান্তরে জনগণকেই বহন করতে হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া :
খাদ্যদ্রব্যের তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া হলো নতুন করে দারিদ্র্যের জন্ম দেয়া । বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ধারণার চেয়েও বিশ্বে বেশি হারে বাড়ছে দারিদ্র্য । বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটিতে উঠে গেছে । অথচ চার বছর আগেও ছিল ৯৮ কোটি ৫০ লাখ । এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সৃষ্ট খাদ্যসঙ্কট । একই সময়ে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৫ কোটি । আমাদের দেশেও প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে । আর তাতে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে সবচেয়ে বেশি । অধিক ব্যয় করার ক্ষমতা এদেশের অধিকাংশ মানুষের নেই । কিন্তু পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে । ফলে এ পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের মান , কমছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান । শিশুরাই সবচেয়ে বেশি এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে । খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে হাজার হাজার শিশু । নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে , সাথে সাথে বাড়ছে সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিরতা । কেননা পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে জীবনধারণের জন্যে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে মানুষ অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার :
দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিকার করার জন্যে সরকারি , বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি । এক্ষেত্রে প্রথমেই সরকার একটি দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে । এ আইনের আওতায় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ , চোরাকারবারি প্রতিরোধ , অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস , দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে । এ ব্যাপারে তদারকির জন্যে সরকার ‘ পণ্যমূল্য মনিটরিং সেল ' নামে একটি সেল গঠন করে জোরদার ভূমিকা নিতে পারে । আভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারিভাবে বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় । আমাদের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান অর্থনীতি । এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে । দরিদ্রপ্রধান দেশে সরকারের প্রয়োজন দরিদ্রদের জন্যে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যপণ্যের ব্যবস্থা করা । সরকারিভাবে চাল মজুদ করতে হবে যেন বাজারে সংকট মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় । রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতার মাধ্যমে হরতাল , ধর্মঘট অবরোধ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে । তবেই দেশের জনগণ তথা দেশীয় অর্থনীতি লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবে।
উপসংহার :
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয়ের মানুষের জীবনকে করছে জর্জরিত , এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী , সরকার ও জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব । তবেই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ জীবন ধারণে স্বস্তিবোধ করবে । তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে যেভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে , তার সঠিক প্রতিরোধ বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয় । তবুও দেশীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্যে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যেতে হবে সবাইকে ।