প্রবন্ধ রচনা: ছাত্রী উপবৃত্তি ও নারীশিক্ষা | নারীশিক্ষার প্রসারে ছাত্রী উপবৃত্তি | JSC, SSC, HSC
ছাত্রী উপবৃত্তি ও নারীশিক্ষা
এছাড়াও আরো যে সকল বিষয় সম্পর্কে লিখতে পারবে:
👉🏻ছাত্রী উপবৃত্তি
👉🏻নারীশিক্ষার প্রসারে ছাত্রী উপবৃত্তি
ভূমিকা :
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার । এ অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রে সমান হওয়া বাঞ্ছনীয় । কিন্তু আমাদের দেশে অভিভাবকগণ ছেলে সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে যতটা সচেতন , মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে ততটা নন । ফলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষার হার কম । কিন্তু একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে নারী - পুরুষের সমান শিক্ষিত হওয়া অত্যাবশ্যক । সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন , “ তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও , আমি তোমাদের শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ জাতি উপহার দেব । " মহানবি ( স ) বলেছেন , “ শিক্ষা গ্রহণ করা প্রতিটি নারী - পুরুষের জন্যে ফরয । " অর্থাৎ কি ধর্মীয় , কি সামাজিক , কি অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই নারীশিক্ষার আবশ্যকতা অপরিসীম । সেই দিকটিকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ সরকার মেয়েদের শিক্ষালাভে আগ্রহী করে তোলার জন্যে ছাত্রী উপবৃত্তি চালু করেছে । বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয় ।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষা :
নিরক্ষরতা বাংলাদেশের একটি বড় অভিশাপ । এ অভিশাপ থেকে এদেশ এখনো মুক্তিলাভ করতে পারে নি । এর অন্যতম কারণ দারিদ্র্য । বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে । আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে ইচ্ছে থাকলেও অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের পাঠাতে পারছেন না বিদ্যালয়ে । ছেলে সন্তানকেই যেখানে পড়ালেখা শেখাতে অক্ষম , সেক্ষেত্রে মেয়ে সন্তানকে পড়ালেখা করতে পাঠানোর চিন্তা অকল্পনীয় । এটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি । কিন্তু শিক্ষার মূল ধারার সাথে নারীদের সম্পৃক্ত করা না হলে সর্বজনীন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয় । নারীদের শিক্ষিত করা না গেলে তাদের সন্তানরাও অশিক্ষিত থেকে যাবে । সুতরাং একথা স্বতঃসিদ্ধ যে , নারীশিক্ষা বিস্তার দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টারই অংশবিশেষ ।
নারীশিক্ষার গুরুত্ব :
সৃষ্টির সেই প্রথম লগ্ন থেকে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি জীবন গঠনে সমান ভূমিকা পালন করে চলেছে । মানুষ যখন বনে - জঙ্গলে বসবাস করত তখন নারীরা পুরুষের পাশে থেকে সমানভাবে কাজ করেছে । নারী আজ শুধু অন্তঃপুরবাসিনী নয় , পুরুষের সঙ্গে তারাও সমান তালে পথ চলছে । উন্নত বিশ্বে নারীজাগরণের ফলে তাদের সমাজব্যবস্থায় এসেছে গতি ও সমৃদ্ধি । নারীরা কর্মে ব্যাপৃত থাকলে জাতীয় উন্নতি হবে ত্বরান্বিত । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কারণেই লিখেছেন-
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী , অর্ধেক তার নর । "
নারী-সচেতনতা সৃষ্টি :
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাংলাদেশের পুরুষরা দীর্ঘদিন ধরে নানারকম মানবিক অধিকার থেকে বঞ্ছিত রেখেছে নারীদের। আধুনিক সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের দিনেও শেষ হয় নি সে বঞ্ঝনার অপমান। পাশ্চাত্য সভ্যতার দেখাদেখি নারীরা পুরুষের পাশাপাশি ঘরের বাইরে এলেও তারা এখনো নির্ভরশীল পুরুষের ওপর। নারীশিক্ষার হার এখনো পুরুষের সমান নয়, অনেক কম। এমতাবস্থায়, নারী সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশের যথাযথ অগ্রগতি সাধন করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন নারীশিক্ষার।
নারীশিক্ষার প্রসারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ :
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে নারীদের বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। নীতি নির্ধারণেও রয়েছে নারীর অংশগ্রহণ। এমনকি নারী প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সাংসদ সদস্য ইত্যাদিও হতে পারছে। তারপরও নারীদের অবস্থার যথোচিত উন্নতি হয়েছে একথা বলা যায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে শিক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৪ সালে 'কায়রো' সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশসহ ১৭৯টি দেশের অংশগ্রহণে ১১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাবনায় সাম্য, ন্যায়বিচার ও সন্তান ধারণের প্রশ্নে নারীর ইচ্ছার প্রাধান্য, নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। সিডো'-র প্রস্তাবনা এবং বেইজিং সম্মেলনেও নারীর ক্ষমতায়ন ও 'জেন্ডার' প্রসঙ্গ প্রাধান্য লাভ করেছে। বলাবাহুল্য, এসব বাস্তবায়নের জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন নারীশিক্ষার প্রসার।
উপবৃত্তি চালুর উদ্যোগ :
জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামগ্রিক উন্নয়নে ইতোমধ্যে ৪টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত নারী উন্নয়ন কৌশলের সাথে ঐকমত্য পোষণ করায় জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাংক, আইডিবি, এডিবি প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দাতা সংস্থা বাংলাদেশে নারীশিক্ষার বিস্তারে আর্থিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়। আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং সরকারের সদিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে নারীশিক্ষা বিস্তারে বহুমুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গৃহীত হয় মেয়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচিটি ।
ছাত্রী উপবৃত্তির স্বরূপ :
অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ছাত্রীরা যেন শিক্ষাবিমুখ তথা ঝরে না পড়ে (ড্রপ আউট), সেজন্যে গ্রাম পর্যায়ে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করে তাদের জন্যে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এই প্রকল্পে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের উপবৃত্তি চালু করা হয়। এই কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক ছাত্রীর জন্যে বই কেনা বাবদ ২৫০ টাকা এবং মাসিক ৪০ টাকা হারে বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রদত্ত অর্থ দ্বারা ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন এবং পরীক্ষার ফি ছাড়া কিছু হাত খরচের টাকা বেঁচে যায়। এর বাইরে বোর্ড পরীক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকা প্রত্যেক ছাত্রীকে প্রদান করে সরকার। পরবর্তীকালে সরকার এই প্রকল্পকে সম্প্রসারিত করে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সৃষ্টি হয় শিক্ষা গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ। বেতন মওকুফ ছাড়াও সরকার বই কেনা, ভর্তি ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং পরীক্ষার ফি বাবদ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির মেয়েদের সর্বমোট ৩০০ টাকা করে প্রদান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে গ্রামের দরিদ্র এবং অসচেতন অভিভাবকরা উৎসাহিত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে।
উপবৃত্তির সম্প্রসারণ :
দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে নারীশিক্ষার প্রতি। এর ফলে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের পথ হয়েছে প্রশস্ত। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণেই যেন গ্রামীণ মেয়েদের শিক্ষার পথ রুদ্ধ না হয়ে যায় সে উদ্দেশেই এই প্রকল্প। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একজন ছাত্রী মাসে ৬০ টাকা হারে উপবৃত্তি লাভ করে। এছাড়া বই কেনা ও বোর্ড পরীক্ষার প্রয়োজনীয় অর্থও প্রদান করে সরকার।
ছাত্রী উপবৃত্তির সুফল:
বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। এদের অবহেলা করে জাতীয় উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। সরকার জাতীয় স্বার্থে এ প্রকল্প গ্রহণ করায় নারীশিক্ষার হার এবং ছাত্রী সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপবৃত্তির সুফল হিসেবে বাল্যবিবাহ বা অকাল বিবাহের হার হ্রাস পেয়েছে। আগে গ্রামের অভিভাবকগণ প্রাইমারি শিক্ষালাভের পর পরই মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে পড়তেন কিন্তু এখন তারা মেয়েকে লেখাপড়া শেখার জন্যে পাঠাচ্ছেন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সংগতভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে নারীশিক্ষার হার এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অধ্যয়নের সুবিধা।
উপবৃত্তিকে নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ:
সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উপবৃত্তিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির শিক্ষক ও স্কুল পরিচালনা পরিষদের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। একই ছাত্রীকে একাধিক স্কুলে ভর্তি দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া, খাতায় যত নাম দেখানো হয়, বাস্তবে তত ছাত্রী না থাকাও দুর্নীতির আরেকটি মাধ্যম। বৃত্তিপ্রাপ্তির শর্তসমূহও যথাযথভাবে অনুসৃত হয় না। সরকার এ ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাংকের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়নে করণীয়:
সরকারের এই মহৎ প্রকল্পটিকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে সকল সচেতন ব্যক্তির এগিয়ে আসা আবশ্যক। আর এ প্রকল্পের সাথে যারা জড়িত, তাদের শুভবুদ্ধির উদ্রেক হওয়া উচিত। এসব ব্যক্তিকে সকল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে দুর্নীতিমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। সরকারকে বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। কেননা, এক যুগ পূর্বের বাজারমূল্য এক যুগ পরে প্রযোজ্য হতে পারে না। অন্যদিকে, অভিভাবকদের কেবল অর্থের লোভে মেয়েকে স্কুলে না পাঠিয়ে মেয়ের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ ও সাবলম্বী হওয়ার জন্যে দৃষ্টি দিতে হবে।
উপসংহার:
নারীশিক্ষা বিস্তারে উপবৃত্তির ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। এর ফলে মেয়ের দরিদ্র পিতামাতার ওপর চাপ কমে এবং ভারমুক্তভাবে তারা মেয়ের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে পারে। উপবৃত্তি একজন ছাত্রীর শিক্ষার আগ্রহকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে। পাশাপাশি অভিভাবকও আগ্রহী হয়ে ওঠেন মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠাতে। বস্তুত, উপবৃত্তির মাধ্যমে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটায় এর প্রভাব সুনিশ্চিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক। এই প্রকল্প যেন আরও প্রসারিত হয়, মেয়েরা যেন আরও সহজে শিক্ষায় অগ্রসর হতে পারে- সে প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে আমাদের সকলকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন