ধ্বনি ও বর্ণ , বর্ণমালা ও লিপি
ধ্বনি ও বর্ণ কাকে বলে?
ধ্বনি হচ্ছে বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ভাষার ক্ষুদ্রতম উপাদান , যা মানুষ পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্যে ব্যবহার করে থাকে । আর বর্ণ হচ্ছে ধ্বনির লিখিত রূপ ।
ধ্বনি ভাষার মূল উপাদান হলেও তা খুবই ক্ষণস্থায়ী ; উচ্চারণ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । - যিনি কাছে থাকেন , কেবল তিনিই তা শুনতে পান । মানুষ তার ভাবনাকে দীর্ঘস্থায়ী করে দূরের এবং অনাগত কালের মানুষদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে ধ্বনির এক ধরনের চিহ্ন আবিষ্কার করেছে । এসব চিহ্নকেই বলা হয় বর্ণ ।
ধ্বনি উচ্চারণীয় ও শ্রবণীয় , কিন্তু বর্ণ দৃশ্যমান । মূলত , বাগ্ধ্বনিকে একটা দৃশ্যরূপ দেওয়ার জন্যেই বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে । তবে একটি বর্ণে একাধিক ধ্বনিও থাকতে পারে । কথা বলার সময় আমরা যতগুলো ধ্বনি উচ্চারণ করি , লেখার সময় ততগুলো বর্ণ লিখি না । যেমন : ' কলম ' শব্দটি বলতে গিয়ে আমরা উচ্চারণ করি ক্ + অ + ল্ + অ + ম্ + অ এই ছয়টি ধ্বনি কিন্তু লিখি তিনটি বর্ণে ( ক + ল + ম ) । তেমনি খ্ + আ + ত্ + আ = খাতা ।
এভাবে ধ্বনির পর ধ্বনি সাজিয়ে আমরা কথা বলি আর বর্ণের পর বর্ণ সাজিয়ে তা লিখে রাখি ।
বর্ণমালা ও লিপি
বর্ণের সমষ্টিকে বলা হয় বর্ণমালা । যেমন ‘ অ ’ একটি বর্ণ , ‘ ক ’ একটি বর্ণ , এরকম সবগুলো বর্ণকে একত্রে বলা হয় বর্ণমালা । এই বর্ণগুলো বিভিন্ন ধ্বনির লিখিত রূপ বা চিহ্ন । ধ্বনিকে লিখিত বা দৃশ্যরূপ দেওয়ার জন্যে সেই আদিকাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন চিহ্ন ব্যবহার করে আসছে । ধ্বনির লিখিত রূপের ওইসব আদি চিহ্নকে বলা হয় লিপি । অর্থাৎ লিপিগুলোই ক্রমান্বয়ে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক বর্ণে রূপলাভ করেছে । বাংলা লিপির জন্ম কুটিল লিপি থেকে । কুটিল লিপি আবার ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ও বহুল প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপির বিবর্তিত রূপ । খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দে রাজা অশোকের শাসনামলে ব্রাহ্মীলিপি পাওয়া যায় । আধুনিক বাংলায় লিপির প্রয়োগ না থাকলেও লিপিচিহ্নের প্রয়োগ রয়েছে । লিপিতে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের ক্ষেত্রে নানা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে , সেগুলোকে আমরা কার ও ফলা বলি । যুক্তব্যঞ্জনে অনেক ব্যঞ্জন চিহ্নেরও বিকল্প সৃষ্টি হয়েছে । নিচের তালিকায় এর কিছু দৃষ্টান্ত দেখানো হলো—
ধ্বনির উৎপাদন
ভাষার ধ্বনিসমূহ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের শরীরের ফুসফুস বিশেষ ভূমিকা পালন করে । কারণ ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখ ও নাক দিয়ে যে বাতাস বেরিয়ে যায় , তা ফুসফুস থেকেই আসে । ফুসফুসতাড়িত বাতাস মুখ ও নাক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধ্বনি তৈরি হয় । ধ্বনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুসফুস ছাড়াও নিচের বাপ্রত্যঙ্গগুলোর ভূমিকা রয়েছে ।
স্বরযন্ত্র : শ্বাসনালির ওপরের একটা নরম মাংসল উঁচু প্রত্যঙ্গের নাম স্বরযন্ত্র । এর ভেতরে দুটো সূক্ষ্ম তন্ত্রী ( cord ) আছে । এদের স্বরতন্ত্রী বলে । ফুসফুস থেকে আগত বাতাস স্বরতন্ত্রী কাঁপিয়ে বের হলে ধ্বনি ঘোষ বা গম্ভীর হয় ; না কাঁপিয়ে বের হলে ধ্বনি হয় অঘোষ । বাংলা স্বরধ্বনিসমূহ অঘোষ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনি অঘোষ আর তৃতীয় , চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনি ঘোষ ।
![]() |
চিত্র: প্রধান প্রধান বাক্ প্রত্যঙ্গ |
ঠোঁট : প , ফ , ব , ভ , ম- এই পাঁচটি ধ্বনির উচ্চারণে দুই ঠোঁটের সাহায্যে শ্বাসবায়ুকে প্রথমে বেরোতে বাধা দিয়ে পরে ছেড়ে দেওয়া হয় ।
দাঁত : ত , থ , দ , ধ , ন– এই পাঁচটি ধ্বনির উচ্চারণে দাঁতের গোড়ার সঙ্গে জিভের ডগা লাগানো হয় ।
জিভ : জিভ বা জিহ্বা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাষ্প্রত্যঙ্গ । এর গোড়া , পাতা ও ডগা মুখবিবরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে লাগিয়ে বেশ কিছু ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় ।
দাঁতের মাড়ি : দাঁতের মাড়িতে জিভের ডগা ছুইয়ে ন , র , স ইত্যাদি ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় ।
তালু : আলজিভ থেকে ওপর পাটি দাঁতের গোড়া পর্যন্ত ধনুকের মতো বাঁকানো ছাদ বা চালের পুরো অংশ হচ্ছে তালু । এর দুটো অংশ । সামনের শক্ত অংশটি শক্ত তালু আর পেছনের নরম মাংসল অংশটি কোমল তালু । শক্ত তালুতে জিভের পাতা এবং কোমল তালুতে জিভের গোড়া ঠেকিয়ে বিভিন্ন ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় ।
নাক : বাগ্ধ্বনির উচ্চারণে নাসিকা বা নাকেরও ভূমিকা রয়েছে । ঙ , ন , ম ইত্যাদি ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় শ্বাসবায়ু মুখের বদলে নাক দিয়ে বেরিয়ে যায় । তাছাড়া স্বরধ্বনির আনুনাসিক উচ্চারণেও আংশিক বাতাস নাক দিয়ে বেরিয়ে যায় ।
মূর্ধা : মুখের ওপরের ছাদে যেখানে শক্ত তালুর শেষ ও কোমল তালুর শুরু , তার নাম মূর্ধা । ঠোঁটের ডগা একটু উল্টিয়ে মূর্ধার সঙ্গে লাগিয়ে বাংলা মূর্ধন্য ধ্বনিসমূহ উচ্চারণ করা হয় ।