রক্তাক্ত নামাজ
যুদ্ধ শেষ । মদীনায় ফেরার পালা । চলতে চলতে রাত হলাে । পাহাড়ী এলাকায় রাত কাটাতে হবে । এলাকাটা নিরাপদ নয় । যে কোনাে সময় হামলা আসতে পারে । শত্রুপক্ষের হামলা । কাজেই সবাইকে ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না । দু'একজন সজাগ থাকতে হবে । পাহারা দিতে হবে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবাইকে ডাকলেন । বললেন , আজ রাতে জামাতকে পাহারা দিতে হবে । বলাে , পাহারাদারী করবে কে ? কে এজন্য প্রস্তুত?
প্রশ্নবাণী উচ্চারণ হতেই ভাগ্যবান দু’সাহাবী লাব্বাইক বলে দাড়িয়ে গেলেন । একজন মােহাজের অপরজন আনসার । একজন হযরত আম্মার রা , অপরজন হযরত আব্বাদ রা .। দু'জনেই সবিনয় আরজ করলেন , এ কাজের দায়িত্ব নিতে আমরা প্রস্তুত , হে আল্লাহর রাসূল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ের আবেদন মঞ্জুর করলেন । পাহাড়ের যেদিক থেকে শত্রু আসার আশঙ্কা ছিল সেদিকটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন , তােমরা ওখানে গিয়ে পাহারাদারী করবে।
পাহারা দিতে এসে দু'জনেই আলােচনায় বসলেন । কিভাবে পাহারা দিলে ভালাে হবে সেই আলােচনা । এ তাে আর এক দুঘন্টার ব্যাপার নয় , সারারাত জেগে থাকতে হবে । বুঝে - শুনেই পাহারার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আলােচনা চলতে থাকল । একজন বললেন , চলুন আমরা রাতটিকে দু ভাগে ভাগ করে নেই । একভাগে আপনি পাহারা দিবেন আর আরেক ভাগে আমি পাহারা দিব।
কেন ? একসঙ্গে দু’জন জেগে পাহারা দিলে অসুবিধা কি ? আরেক জনের প্রশ্ন ।
অসুবিধা আছে বৈকি।
একটু বুঝিয়ে বলুন।
এক সঙ্গে উভয়ে জেগে থাকলে এমনও হতে পারে যে , কোনাে এক সময় টলতে টলতে উভয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারি । তখন এর পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে নিজেই একটু ভেবে দেখুন।
একজন ঘুমিয়ে থাকলে শত্রু এসে যদি আরেক জনকে একা পেয়ে আক্রমণ করে বসে?
তাতে কোনাে সমস্যা নেই । কেননা সে তখন অপর জনকে জাগিয়ে দিবে।
শেষ পর্যন্ত ভাগাভাগি করেই পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলাে । প্রথম ভাগে পাহারা দিবেন হযরত আব্বাদ রা , আর দ্বিতীয় ভাগে পাহারা দিবেন হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা .।
সিদ্ধান্ত মােতাবেক রাতের প্রথম ভাগে আম্মার রা , ঘুমিয়ে পড়লেন । আর আব্বাদ রা . সজাগ থেকে পাহারা দিতে লাগলেন।
পাহারা দিতে দিতে হযরত আব্বাদ রা . ভাবলেন , জেগেই যখন আছি তখন আর অনর্থক বসে সময় নষ্ট করে লাভ কি ! নামাজে দাড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকি । যেই চিন্তা সেই কাজ । শুরু করলেন নামাজ পড়া।
এদিকে হলাে কি , রাত গভীর হওয়ার পর পা টিপে টিপে কাফেলার দিকে এগিয়ে আসে এক কাফের শত্রু । হঠাৎ দূর পাহাড়ের টিলায় ছায়ার মত কি যেন দেখে সে ধারণা করে , এ নিশ্চয়ই কোনাে মুসলমান হবে । দলকে পাহারা দিচ্ছে । মাত্র একজন মানুষ ! একে তীর মেরে হত্যা বা আহত করে ফেলা কোনাে ব্যাপারই নয় । সুতরাং এ সুযােগ কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায় না।
শত্রুটি চুপে চুপে আরাে এগিয়ে এল । তারপর তীর মারতে শুরু করল হযরত আব্বাদ রা.কে লক্ষ্য করে । পর পর তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হলাে হযরত আব্বাদ রা . - এর পিঠে । গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল তাজা রক্তের ধারা । এদিকে আব্বাদ রা , ডুবে আছেন পবিত্র কালামের মধুময় তিলাওয়াতে । কী যে গভীর সে তিলাওয়াতের স্বাদ ! কত যে মজা মহান প্রভুর ঐশি গ্রন্থে !! পিঠে বিদ্ধ তীরের যন্ত্রণা তাে সে তুলনায় অতি তুচ্ছ।
তিনি নামাজে থেকেই হাত দিয়ে টেনে তীরগুলাে খুলে ফেললেন । নড়াচড়া করলেন না বিন্দু পরিমানও । অবশেষে শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে রুকু সিজদা আদায় করে নামাজ শেষ করলেন।
নামাজ শেষ । গােটা দেহ রক্তে রঞ্জিত । আব্বাদ রা . এগিয়ে এলেন । ডেকে তুললেন , প্রহরী বন্ধু হযরত আম্মার রা.কে। শত্রু পক্ষের লােকটি যখন দেখল , পাহারাদার একজন নয় , দুজন ; তখন সে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল।
জেগে উঠে আম্মার রা . দেখলেন , হযরত আব্বাদ রা . এর দেহের তিন জায়গা থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে । এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আম্মার রা , সীমাহীন বিস্মিত হলেন । বললেন , সুবহানাল্লাহ ! আপনি আমাকে আগে ডাকলেন না কেন ? জবাবে হযরত আব্বাদ রা , এক আকাশ বিশ্বাসকে কণ্ঠে ড়িয়ে নরম ভাষায় বললেন , আসলে আমি পবিত্র কুরআনের এমন একটি সূরার তিলাওয়াত শুরু করেছিলাম যার অলৌকিক স্বাদ ও আকর্ষণের পবিত্র বেষ্টনি ভেদ করে বাইরে চলে আসতে আমার মন চায় নি । তাই তিলাওয়াত শেষ করেই তােমাকে ডাকলাম । যদি পাহারা দেওয়ার এই দায়িত্ব আমার কাঁধে না থাকত , তবে আঘাতে আঘাতে মরে যেতাম ; তবু সূরা শেষ না করে রুকুতে যেতাম না।
হযরত আম্মার রা . , হযরত আব্বাদ রা.এর এই আবেগময় কথা শুনে অভিভূত হলেন । মনে মনে ভাবলেন , আহা , কুরআনকে তিনি কত ভালবাসেন ! জীবনের চেয়েও তার কাছে তিলাওয়াতের দাম বেশি।
হে আল্লাহ ! আমাদেরকেও তুমি হযরত সাহাবায়ে কেরামের মতাে কুরআন তিলাওয়াত ও নামাজের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দাও । আমীন । [সূত্র : আদ - দুররুল মানদুদ ]