বাংলার মুক্তিযুদ্ধ
এছাড়াও আরো যে বিষয় সম্পর্কে লিখতে পারবে:
[সংকেত : ভূমিকা – দ্বি -জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন – বাংলার ওপর শোষণ ও বৈষম্য –উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচন –স্বাধীনতার ঘোষণা – অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন –সর্বাত্বক মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় –উপসংহার।]
ভূমিকা :
স্বাধীনতাহীনতায় কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে চায় না । কবির ভাষায়—
“স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়?
বাংলার মানুষও পরাধীনতাকে মেনে নিতে চায় নি । কিন্তু স্বাধীনতা এমনিতেই অর্জিত হয় নি । লক্ষ প্রাণের তাজা রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা - সূর্য । তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গৌরবের অধ্যায় হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ।
দ্বি - জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন :
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষের স্বাধিকারকে মেনে নেয় । দ্বি - জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র । তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা ও অসাধুতায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ভৌগোলিক , সাংস্কৃতিক ও জাতিগত দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একক রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল ।
বাংলার ওপর শোষণ ও বৈষম্য :
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্লজ্জ শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয় । জনসংখ্যা ও সম্পদে বাংলাদেশের প্রাধান্য থাকলেও এদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় । এদেশের সম্পদ দিয়ে গড়ে তোলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত । সেনাবাহিনী , সিভিল সার্ভিস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালির প্রবেশাধিকার প্রায় রুদ্ধ করা হয় । বাঙালি রাজনীতিবিদদের যোগ্যতার প্রতিও কোনো সম্মান প্রদর্শন করা হয় নি । শোষণ ও বৈষম্যের নীতি অনুযায়ী বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের অপমৃত্যু ঘটাতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয় । ফলে বাংলার মানুষ মায়ের ভাষা , মুখের ভাষা হরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাপ্রেমী তরুণদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয় । শহিদ হন সালাম , বরকত , জব্বার , রফিক প্রমুখ । ভাষাকে উপলক্ষ্য করে বাংলার মানুষের মাঝে দেখা দেয় নতুন জাতীয় চেতনা তথা স্বাধিকারের প্রেরণা ।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচন :
শোষণ - নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ১৯৬৯ সালে বিস্ফোরিত হলো । সারাদেশ ভাসতে থাকে আন্দোলনের অগ্নিস্রোতে । গণঅভ্যুত্থান ও তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় । অবশেষে এল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন । বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দেয় । আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল । রাষ্ট্র শাসনের অধিকার পেল আওয়ামী লীগ । কিন্তু স্বাধীনতাকামী জনগণের এ গণতান্ত্রিক রায়কে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা শাসকরা মেনে নিল না । ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু করল টালবাহানা । আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যের সমাবেশ ঘটালো অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল । শুরু হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ ।
স্বাধীনতার ঘোষণা :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে ঘোষণ করেন ' এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । ' শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ।
অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন :
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার । জেনারেল এম . এ . জি . ওসমানীর নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট , ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস , পুলিশ , আনসার , নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী । এতে দেশের ছাত্র - তরুণসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় । পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার - আলবদর দেশব্যাপী চালাতে থাকে হত্যা , লুটতরাজ ও ধর্ষণ । মুক্তিবাহিনীও দেশমাতৃকার স্বাধিকার অর্জনে চালায় প্রাণবাজি লড়াই ।
সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় :
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় । মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলায় হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে । দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ । প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশ সাহায্যের হাত বাড়ায় । ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো । ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সরাসরি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । শুরু হয় যৌথ আক্রমণ । মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ৪ ডিসেম্বর হতে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকবাহিনী তাদের সবগুলো বিমান হারায় । যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে । যৌথবাহিনী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেলে । ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে শত্রুমুক্ত হয় । ১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নেয় । ১৬ ডিসেম্বর সকাল দশটায় যৌথবাহিনী ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে পৌছালে পাকিস্তানি জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণ করেন । যৌথবাহিনী সকাল ১০ টা ৪০ মিনিটে ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করে । এদিনই বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ( রেসকোর্স ময়দানে ) পাকবাহিনীর অধিনায়ক লে . জেনারেল নিয়াজী তার ৯৩ হাজার অনুগত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে । এদিন বিশ্বের বুকে ঠাঁই করে নিল নতুন একটি মানচিত্র নতুন একটি দেশ ‘ বাংলাদেশ ’
উপসংহার :
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের ইতিহাস , সাফল্যের ইতিহাস । মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে না । মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের সমাজকে গড়ে তলতে হবে ।