শ্রমের মর্যাদা
এছাড়াও আরো যে বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবে:
ভূমিকা :
কর্মই জীবন । শ্রম ছাড়া জীবনে উন্নতির প্রত্যাশা করা বৃথা । শ্রমের মাধ্যমে জীবনে যে সাফল্য আসে এবং তার ফলে যে আনন্দ ও তৃপ্তি পাওয়া যায় , তা সত্যিই নির্মল ও অতুলনীয় । মনীষী কার্লাইলের দৃষ্টিতে দুই শ্রেণির মানুষ শ্রদ্ধার পাত্র । এক শ্রেণি হলো কৃষক ও শ্রমশিল্পী– যারা পরিশ্রমের মাধ্যমে অন্ন - বস্ত্রের সংস্থান করে । আর অন্য শ্রেণিতে রয়েছেন জ্ঞানসাধক— যাঁরা আত্মার খাদ্য সংস্থানে ব্যাপৃত । মূলত শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে । কথায় বলে— “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।”
শ্রম ও জীবন :
মানুষকে জীবনে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে অহরহ লড়াই করে টিকে থাকতে হয় । জীবন অর্থ কর্মক্ষেত্র , আর কর্মক্ষেত্র ভয়াবহ সমস্যাসঙ্কুল । জীবন ব্যাপী কঠোর শ্রমের মাধ্যমে মানুষকে জীবনযুদ্ধে নিয়োজিত থাকতে হয় । আমরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের পরিসরে পরিশ্রম করে জীবিকানির্বাহের প্রয়াস পাচ্ছি । পরীক্ষার ফলাফল থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রম অপরিহার্য । অতএব দেখা যায় , জীবন ও পরিশ্রম পরস্পর সম্পূরক ।
শ্রমের প্রয়োজনীয়তা :
মানবজীবনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । শ্রম ছাড়া মানুষ কখনো উন্নতি করতে পারে না । জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে মানুষকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয় । এ পৃথিবীতে যত বড় বড় কাজ সমাধা হয়েছে সেগুলোর মূলে রয়েছে শ্রম । এ পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি শ্রমশীল সে জাতি তত বেশি উন্নতি লাভ করেছে । পরিশ্রম দ্বারা মানুষ জীবজগতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে এবং প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর নিজেদের প্রভাব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে । ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শ্রমশীলতা উন্নতির পূর্বশর্ত । মনীষী ব্রাভো বলেছেন , “ খোদার বিশ্বাসের পরেই আসে শ্রমের ওপর বিশ্বাস । ”
উন্নত দেশে শ্রমের মর্যাদা :
উন্নত দেশগুলোতে শ্রমের মর্যাদা যথাযথ স্বীকৃতি লাভ করেছে । আর এই স্বীকৃতির জন্যে সেখানকার জনসাধারণ অত্যন্ত কর্মঠ । ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের কল্যাণসাধনের জন্যে তারা সচেষ্ট এবং তাতে সাফল্যও অর্জন করেছে । তারা আমাদের দেশের মানুষের মতো কোনো কাজকেই ছোট বলে মনে করে না । সমাজের উঁচুস্তরের লোকেরা অতি নগণ্য কাজও অত্যন্ত মনোযোগসহকারে সম্পাদন করে । কাজকে ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে বলেই তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে ।
মানসিক উন্নতিতে শ্রম :
মানসিক উন্নতির জন্যে শ্রম অপরিহার্য । কথায় আছে ' অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা । যে লোক শ্রমবিমুখ তার মনে কখনো সুচিন্তা ও সম্ভাব উদয় হয় না ; বরং তার মন কুচিন্তার আশ্রয়স্থল হয়ে পড়ে । পরিশ্রমী ব্যক্তির মন ও মস্তিষ্ক কুচিন্তা থেকে সর্বদা দূরে থাকে । সে সর্বদা নিজেকে উৎপাদন ও উন্নয়নের অনুষঙ্গ বলে ভাবতে শেখে এবং তার আত্মসম্মান ও মানসিক পরিতৃপ্তি বৃদ্ধি পায় ।
পৃথিবীর শ্রমশীল ব্যক্তিত্ব :
পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তি ও মনীষীদের সকলেই কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন । জর্জ ওয়াশিংটন , আব্রাহাম লিংকন , আইনস্টাইন এক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টাত্ত । ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ ( স ) কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন । দোজাহানের রাজাধিরাজ হয়েও তিনি শ্রমের মাধ্যমে অন্নের সংস্থান করতেন । ইসলাম ধর্মের বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর অসীম ধৈর্য ও পরিশ্রমই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে । হযরত ফাতিমা ( রা ) নিজের হাতে যাতা ঘুরিয়ে আটা বানাতেন । কোরানের অনুলিপি ও টুপি তৈরি করে জীবিকার্জন করতেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব । বস্তুত পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের নিরন্তর শ্রম - সাধনা দ্বারা অর্জিত জ্ঞান ও সৃষ্টির গৌরবে ।
শ্রম ও সভ্যতা :
শ্রমের নিরস্তর সাধনায়ই গড়ে উঠেছে সভ্যতার সুরম্য প্রাসাদ । যুগে যুগে মানুষের শারীরিক ও মানসিক শ্রম বিনিয়োগে সমগ্র পৃথিবীর অবকাঠামো , শিল্পকলা ও জ্ঞান - বিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নতি অর্জিত হয়েছে । পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করার জন্যে সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ চেষ্টা চালিয়ে আসছে । তাই শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সভ্যতার ভিত । সভ্যতা বিনির্মাণে শ্রমজীবী মানুষের অসামান্য অবদান স্বীকার করে নজরুল তাই উচ্চারণ করেছেন—
প্রকৃতিতে শ্রমশীলতার উদাহরণ :
প্রকৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গ নিজ কর্মে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত । প্রতিটি গ্রহ - নক্ষত্র আপন আপন কক্ষপথে ঘুরছে । সাগর নদী বইছে অনবরত । বৃক্ষ নীরব শ্রমে আত্মবিকাশের সাধনায় ব্যস্ত । ছোট্ট পিপীলিকার ছয়টি পা প্রতিমুহূর্তে ব্যস্তভাবে ছুটছে । ক্ষুদ্র মৌমাছি মধু সঞ্চয়ে ভনভন করে ঘুরছে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে । পশুপাখি মুহূর্তের জন্যে আলস্যের সুযোগ পায় না । যদিও তাদের জীবনে জৈবিকভাবে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো প্রয়োজন নেই । অপরদিকে মানুষকে জীবনে অসংখ্য দায়িত্ব পালন করতে হয় । তাই তাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না । স্রষ্টার দেওয়া শরীর ও মেধাগত শক্তি যথাযথ ব্যবহার করেই তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে হয় । পালন করতে হয় অসংখ্য দায়িত্ব ।
আমাদের দেশে শ্রম :
কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের এক ধরনের অনীহা ও ঘৃণা রয়েছে । ফলে শিক্ষিত সমাজের একটি বিরাট অংশ কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে আছে । চরম বেকারত্ব ও আর্থিক অনটনের সত্ত্বেও তারা পরিশ্রমবিমুখ । তারা যেকোনো উপায়ে একটি দাপ্তরিক চাকরি যোগাড় করতে ব্যস্ত । যদিও বাংলাদেশে দাপ্তরিক চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত । ফলে বেকারত্ব , হতাশা , দুর্নীতি ও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে । সৃষ্টি হয়েছে নানামুখি সামাজিক অবক্ষয় । এরই ফলশ্রুতিতে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে আজও আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সাধন করতে পারি নি ।
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা :
মহানবি হযরত মুহম্মদ ( স ) পরিশ্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন । তিনি নিজেও শ্রমিকদের সাথে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন । শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকানোর আগেই তিনি তার পারিশ্রমিক পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । শ্রমকে উৎসাহিত করে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করার জন্য মহানবি ( স ) অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন । তিনি ভিখারির হাতে কুঠার উঠিয়ে দিয়েছেন । শ্রমিককে তিনি সম্বোধন করেছেন ' ভাই ' বলে ।
উপসংহার :
আধুনিক পৃথিবী কর্ম ও শ্রমমুখর । দেশে দেশে তাই শ্রমজীবী মানুষের বিজয় ঘোষিত হচ্ছে । আমাদের দেশের সামগ্রিক কল্যাণে অবশ্যই শ্রমের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে । শ্রম দেহকে নীরোগ ও মনকে সতেজ করে । শ্রমের যথার্থ মর্যাদাদানের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে । আমরা শ্রমবিমুখ জাতি বলেই বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ।