প্রবন্ধ রচনা: যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই
যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই
এছাড়াও আরো যে বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবে:
সূচনা:
সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ সংঘবদ্ধ সামাজিক জীবনে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল । কিন্তু সে যুদ্ধ ছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম । মানুষ সে লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল বলেই আজ বিশ্বসভ্যতা গৌরবময় শিখরে আরোহণ করেছে । আজও বিশ্বের সর্বত্র যুদ্ধের দামামা বাজতে শোনা যায় । আজকের দিনে মানুষের যুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নয়, যুদ্ধ হয় মানুষকে ধ্বংস করার জন্যেই । যুদ্ধের এ উন্মত্ত আয়োজন বিশ্বশান্তিকে করেছে বিপর্যস্ত , উন্নয়নের গতিকে করেছে স্তিমিত।
যুদ্ধ যুগে যুগে:
অতি প্রাচীনকাল থেকে একদিকে যেমন চলেছে সভ্যতা নির্মাণের প্রচেষ্টা , তেমনি চলেছে সভ্যতা বিধ্বংসী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধের হোলিখেলা । ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে যুদ্ধে । নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তির কারণে সভ্যতার গতি গেছে থমকে । চলতি শতাব্দীর শুরুতে প্রথম মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়া । প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ক্ষত না শুকাতেই চল্লিশের দশকে বিশ্ববাসীকে জড়িয়ে পড়তে হয় আরেকটি মহাযুদ্ধে । এরপরেও ভিয়েতনাম , নিকারাগুয়া , লেবানন , এঙ্গোলা , কম্বোডিয়া , মায়ানমার , ভারত , পাকিস্তান প্রভৃতি স্থানে সংঘটিত হয়েছে বর্বর যুদ্ধ । অতি সম্প্রতি ইরান - ইরাক , ইরাক - কুয়েত , ফিলিস্তিন - ইসরাইল যুদ্ধ ছাড়াও বুয়ান্ডা , জায়ার , শ্রীলঙ্কা , মায়ানমার , বসনিয়া , কাশ্মীর , চেচনিয়া প্রভৃতি স্থানে জাতিগত সংঘাত এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরাচ্ছে । সম্প্রতি সিরিয়ায় সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে চলছে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ , যা ঐ দেশের জনগণের শান্তি বিনষ্ট করছে ।
যুদ্ধের কারণ:
মানব চরিত্রের পশু প্রবৃত্তির প্রাবল্যে অধিকাংশ সময় মানুষ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ - যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠেছে । হিংসা , বিদ্বেষ , সম্পদের অসীম লোভ , প্রভাব বিস্তারের লালসা , ধর্মান্ধতা , রাজনৈতিক স্বার্থপরতা যুগে যুগে যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে । তবে একথা সত্য , অদূরদর্শী রাষ্ট্রনেতাদের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে সংঘটিত যুদ্ধে সাধারণ মানুষ কোনোদিনই অংশ নেয় নি , শান্তিপ্রিয় জনগণ যুদ্ধের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে মাত্র ।
যুদ্ধের কুফল:
যুদ্ধ মানবতাকে পদদলিত করে । যুদ্ধ মানে রক্তপাত , যুদ্ধ মানেই ধ্বংসলীলা । যুগে যুগে যুদ্ধের তাণ্ডব মানুষের ভাগ্যকে করেছে বিড়ম্বিত , সভ্যতাকে করেছে বিপন্ন । হিরোশিমা ও নাগাসাকি আজও বিশ্ববিবেককে বিচলিত করে । যুদ্ধের কারণে কত নিরপরাধ মানুষ যে অকালমৃত্যুর শিকার হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই । কত স্বামী হারিয়েছে প্রিয়তমার মুখ , কত স্ত্রী হারিয়েছে প্রাণপ্রিয় স্বামী । আর কত মায়ের বুক শূন্য হয়েছে তারও কোনো লেখাজোখা নেই । বিশ্বের উন্নয়নধারাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে দেয় নি যুদ্ধ । যে বিপুল সম্পদ যুদ্ধের রসদ ও অস্ত্র সংগ্রহে ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে এই ভূপৃষ্ঠ সোনার প্রলেপে ঢেকে দেওয়া যেত । যুদ্ধ মানুষে মানুষে , দেশে - দেশে ও জাতিতে - জাতিতে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে , বৃদ্ধি করে উত্তেজনা ।
শান্তির অন্বেষায় বিশ্বমানবতা:
সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্তির দিশা খুঁজেছে । কেননা , সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কখনোই যুদ্ধের পক্ষে ছিল না । মানুষ চায় শান্তি ও সমৃদ্ধি । জীবন - বিকাশের পথকে সুন্দর করার প্রয়াসে মানুষ সর্বদাই শান্তির পক্ষে । ধর্মপ্রচারক , সংস্কারক ও মানবতাবাদী মহামানবেরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করে গেছেন । মহানবি ( স ) নবুয়ত লাভের আগেই যুদ্ধময় আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তি সংঘ ' হিলফুল ফুযুল ' । শ্রী চৈতন্য , কবীর প্রমুখ ধর্মগুরু শান্তির পক্ষে কাজ করেছেন । বড় বড় কবি , বিজ্ঞানী , দার্শনিক ও সমাজকর্মী যুদ্ধের দামামা থামিয়ে শাস্তির অমিয় বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নিজেদের শ্রম ও মেধাকে নিবেদন করেছেন ।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ:
মাত্র দু যুগের ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বব্যাপী জেগে ওঠে শান্তি বাদী চেতনা । রাষ্ট্রনায়ক , রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মীরা বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে একটি বিশ্বসংস্থার চিন্তা - ভাবনা করেন । অবশেষে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় ' সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ' বা জাতিসংঘ । বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা একশ তিরানব্বই- যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের কলহ - বিবাদ মেটানো ছাড়াও আগ্রাসী শক্তির দমনে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । জাতিসংঘ ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালন করছে । ন্যাটো , জিসিসি , কমনওয়েলথ , ইইউ , আসিয়ান প্রভৃতি সংস্থা বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন , সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে ।
বিশ্বশান্তি ও বর্তমান বিশ্ব :
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে বর্তমানে প্রশ্ন উঠেছে । মূলত জাতিসংঘ বর্তমান বিশ্বের সংঘাত নিরসনে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে । ইরাক , ফিলিস্তিন , লেবানন , সোমালিয়া , কাশ্মীর প্রভৃতি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা ব্যর্থতায় ভরা । জাতিসংঘ এখন বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আজ্ঞাবহ এক সংগঠনে পরিণত হয়েছে । ফলে বৃহত্তর শক্তিগুলোর ইচ্ছামতো তাকে ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে । আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সক্রিয় উপস্থিতি সত্ত্বেও উপদলীয় সংঘাত লেগেই আছে । ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর ইসরাইলী বাহিনীর নৃশংস দমন - নিপীড়ন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই । পাকিস্তান ও ভারতের মতো দুটি প্রতিবেশী দেশ পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে । তাদের হাতে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র । এক্ষেত্রে উত্তেজনা প্রশমনে কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই বললেই চলে ।
উপসংহার:
স্বার্থান্বেষী মহল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ইন্ধনদাতা । বৃহত্তর শক্তিগুলো তাদের অস্ত্রের বাজারকে সম্প্রসারিত রাখার লক্ষ্যে একমুখে শান্তির কথা বলছে , অন্যমুখে যুদ্ধের আগুনে তেল ঢালছে । তা সত্ত্বেও বিশ্ব মানবতা আজ সেই দিনটির প্রতীক্ষায় রয়েছে , যেদিন দুনিয়ার আকাশ - বাতাস থেকে থেমে যাবে যুদ্ধের দামামা ।
আরো পড়ুন:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন