আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ
ভূমিকা :
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি । হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংহতিতে এদেশের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু ভাবমূর্তির ঔজ্জ্বল্য যুগচাহিদার আলোকে যথেষ্ট নয় । আজও বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশ । পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতি ও দুর্নীতিপ্রবণ দেশও বটে । কোনো সচেতন নাগরিকই মাতৃভূমির এরূপ দর্শনে সুখী হতে পারে না । আমিও বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থায় হতাশ না হয়ে পারি না । ক্ষুধা , দারিদ্র্য , অশিক্ষা , অপুষ্টি , দুর্নীতির উপদ্ধিতি সত্ত্বেও আমি বাংলাদেশকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখি । বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করেও আমি এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশের যপ্ন দেখি , যা দেখার জন্যই ১৯৭১ সালে লাখো মানুষ অকাতরে আত্মাহুতি দিয়েছিল ।
আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ :
একথা সত্যি যে স্বপ্ন বাস্তব নয় , মস্তিষ্কের বিভ্রম মাত্র । তবে আমি বাংলাদেশকে নিয়ে যে যপ্ন দেখি তা শাব্দিক অর্থে স্বপ্ন নয় , কামনার এক অকুণ্ঠ সাধনা মাত্র । আমার স্বপ্নের বাংলাদেশের কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হলো :
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি :
আমি আমার স্বপ্ন - কল্পনায় যে বাংলাদেশের ছবি আঁকি তা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ । বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছে । প্রযুক্তি , মূলধন ও উদ্যোগের অভাব , বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সীমাহীন কষাঘাতের বিপরীতে আমার কল্পিত বাংলাদেশ সমৃদ্ধির শীর্ষে থাকা একটি গর্বিত জাতির নাম । এদেশের মাথাপিছু আয় লুক্সেমবার্গ , জাপান বা সুইজারল্যান্ডের সমান । পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করছে । কলকারখানায় সাবলীল উৎপাদন , রপ্তানি বাণিজ্য বাংলাদেশের পক্ষে এবং শূন্য হারের বেকারত্ব আমার স্বপ্নের বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীনতা :
বর্তমান বাংলাদেশে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের হাতে মোট সম্পদের ৮০ ভাগ কুক্ষিগত । আবার এ ৮০ ভাগের সিংহভাগই মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের দখলে । বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী শতকরা ৩৮ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে । আমি যে বাংলাদেশের ষপ্ন দেখি সেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে । সম্পদের ও অর্থের প্রবাহ সমান্তরাল থাকবে । অপরদিকে সামাজিক ন্যায়বিচার থাকবে সবার নাগালে । সবার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা , আইনগত সহায়তা ও অধিকার থাকবে অবাধ । সাম্যনীতিই হবে রাষ্ট্রনীতি।
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ :
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ পর পর চার বার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে । আমি যে বাংলাদেশের কথা ভাবি সেদেশে দুর্নীতির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না । অফিস - আদালতে ফাইল চলবে নিজের গতিতে । সেখানে তদবির ও ঘুষ নামক শব্দ মানুষের কাছে অপরিচিত মনে হবে । অফিস - আদালতে কর্মফাকি , ওপরওয়ালাদের চাপ , অযোগ্যের উচ্চাসন লাভ আমার কল্পিত বাংলাদেশে থাকবে না । দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থাকবে বিশ্বাঙ্গনে সবার উপরে । দুর্নীতিমুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গর্ববোধ করতে পারব।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি :
আমি দিবা - রাত্রি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও পারস্পরিক সহনশীলতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ । রাজনীতির নামে হরতাল , ধর্মঘট , সন্ত্রাস ও সহিংসতা এখানে থাকবে না । রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা । নির্বাচনে কোনো কারচুপি থাকবে না , নির্বাচনি ফলাফল মেনে নেয়ার ইতিবাচক মনমানসিকতা থাকবে সকল রাজনৈতিক দলের । সকল সমস্যার সমাধান হবে আলোচনার টেবিলে , জাতীয় ইস্যুতে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকবে না কোনো ভিন্ন মত ।
শিক্ষিত ও মননশীল সমাজ :
বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার খুবই কম । সাক্ষরতার হার ৬৫ ভাগের বেশি নয় । আমাদের শিক্ষার মান খুবই নিম্ন এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অক্ষম । আমার কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশে থাকবে শতভাগ শিক্ষিত মানুষ । সে শিক্ষিত বলতে শুধু সনদপত্রধারী কিংবা নামকাওয়াস্তে নামঠিকানা লিখতে পারা নয় । তারা যথার্থ ও যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত । শিক্ষার আলোয় আলোকিত সমাজে সুস্থ সংস্কৃতি ও মননশীলতার একটি অনুপম আবহ বিরাজমান থাকবে । উদারনৈতিক সমাজে মানুষ পাবে আত্মবিকাশের অনুকূল পরিবেশ ।
শিল্পোন্নত বাংলাদেশ :
আমার কল্পিত বাংলাদেশ শিল্প - প্রযুক্তির শীর্ষে অবস্থান করবে । কৃষিভিত্তিক সনাতন ও ভঙ্গুর অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়নের ছোঁয়ায় । বাংলাদেশের প্রযুক্তি ঋণ করবে সারাবিশ্বের মানুষ । প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহারে আমার এদেশ গড়ে তুলবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা । প্রতিটি মানুষের হাত হবে কর্মীর বলিষ্ঠ হাত । আলস্য ও বাগাড়ম্বরের বদলে প্রতিটি মানুষ উৎপাদনে ব্যস্ত থাকবে । পণ্যের মান হবে সর্বোন্নত । ফলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের পণ্য পাবে ঈর্ষণীয় কদর । সমাজে ভেজাল - কালোবাজারি থাকবে না ।
মহাকাশ গবেষণায় উন্নতি :
আমার সপ্নের বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তির থাকবে বিস্ময়কর অগ্রগতি । এদেশের বিজ্ঞানীরা পাড়ি জমাবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে । মানুষ চন্দ্র ভ্রমণে যাবে , মঙ্গলেও গড়বে আবাস । এদেশের মহাকাশ প্রযুক্তি ধার করতে উন্মুখ থাকবে উন্নত বিশ্ব ।
তথ্য ও সমর প্রযুক্তি :
আমার কল্পিত বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজে তথ্য প্রযুক্তির নেতৃত্ব দেবে । বাংলাদেশেরই কোনো এক স্থানে গড়ে উঠবে সিলিকন ভ্যালির মতো এক আইটি পার্ক । যেখানে এসে বিশ্বের ভবিষ্যৎ তথ্য প্রযুক্তিবিদরা ভিড় জমাবেন নিজেদের মেধা শানিত করার জন্যে । আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির অধিকারী- যাতে কোনো দেশই বাংলাদেশের সাথে বড় ভাইসুলভ আচরণ করতে সাহস পাবে না।তবে বাংলাদেশ সত্য ও ন্যায়ের পথে তার সমরশক্তি ব্যবহার করবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ :
আমি কল্পনা করি এমন একটি বাংলাদেশের যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তুলবে কার্যকর ব্যবস্থা ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে কার্যকর অগ্রগতি । জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনগণকে বাঁচাতে গড়ে উঠবে মজবুত অবকাঠামো । নদীশাসন ও লবণাক্ততা নিরসনে গৃহীত হবে যথাযথ ব্যবস্থা । এদেশে পরিবেশ দূষণ থাকবে না । নির্মল ও সুস্থ পরিবেশে মানুষ ভাবনাহীন জীবনযাপন করবে ।
উপসংহার :
আমি জানি বাংলাদেশের পক্ষে কল্পিতরূপে উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ হবে না । তবে একটি জাতি লক্ষ্যপথে অটল থেকে ক্লাজ করলে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতে পারবে । নির্মম ও হতাশাজনক বাস্তবতার পটভূমিতে কখনো কখনো কল্পনায় অবগাহনেই সুখ লাভ করা যায় । তবু আমি চাই আমার কল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হোক ।