সুন্দরবন : ভ্রমণের দিনলিপি
২০ এপ্রিল , সােমবার ২০২১
সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা । প্রকৃতির এত সৌন্দর্য যে এভাবে ছড়িয়ে আছে তা না দেখলে কল্পনায় এর ধারে কাছেও যেতে পারবে না কেউ । আর এই নয়নাভিরাম ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হলাে আমার এই সেদিন । বলছিলাম সুন্দরবনের কথা । প্রকৃতি সেখানে নিজেকে উজাড় করে অকৃপণভাবে ঢেলে দিয়েছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য । আর এই শােভা দর্শনের উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা চার বন্ধু- নিলয় , নাঈম , নাদির এবং আমি ।
প্রায় আঠারাে ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে রাত বারােটায় আমরা উপস্থিত হলাম খুলনায় । অনেক ঘুরে অবশেষে একটা মাঝারি গােছের হােটেলে দুটো ঘর খালি পেয়ে গেলাম । সঙ্গে শুকনাে খাবার ছিল , তা দিয়েই সেরে নিতে হলাে রাতের ভােজ । দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তি পেয়ে বসেছে সবাইকে । চোখ ভেঙে নেমে আসছে রাজ্যের ঘুম । অগত্যা হােটেলের শুভ্র চাদর পাতা বিছানাই হলাে আমাদের রাতের ঠিকানা ।
২১ এপ্রিল , মঙ্গলবার ২০২১
যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল ন'টা । এরপর সুন্দরবনে যাবার প্রস্তুতি , মংলা বন্দর বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা । নদীপথে যাত্রার সব অবলম্বন সংগ্রহ করে যখন আমরা লঞ্চ ' এমভি যাত্রায় চাপলাম তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে । চারদিকে নরম করে দেখা আলাে । পাখিরা ঘরে ফিরছে ।
আমাদের সাথে গাইড হিসেবে রয়েছেন নাঈমের বড় ভাইয়ের বন্ধু স্থানীয় সাব্বির ভাই । উনি জানালেন , আমরা সুন্দবনের সীমানায় প্রবেশ করেছি । আর আমরা সবাই শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে , এতদিন সুন্দরবনের কথা অন্যের মুখে শুনেছি , টিভিতে দেখেছি , বই কি ম্যাগাজিনে পড়েছি । আর আজ নিজের চোখে দেখছি সব ।
নদী অসংখ্য শাখায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে । নদীর গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বনরাজি । একসময় এমনই সরু হয়ে এল নদীপথ যে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলাম একটু সবুজ । চারদিকে প্রচুর গােলপাতা । শেখর যেন আকাশ থেকে পড়ল । অবাক হয়ে বলল , আমি তো ভেবেছিলাম গোলপাতা গােল গােল । সবাই একচোট হাসলাম । সাব্বির ভাই জানালেন এর ফল ও ফুলের কথা । আমরা কেউই জানতাম যে গােলপাতার ফুলও হয় । অবাক হয়ে দুচোখ ভরে দেখলাম সােনার বরণ উজ্জ্বল ফুল ।
ক্রমেই রাত নেমে এল । পাখির কলকাকলি থেমে গেল । রাতের সবুজ ঘন অরণ্যে যেন আরাে বেশি জমাট আঁধার নামল । দূর থেকে হঠাৎ ভেসে আসছে কোনাে কোনাে প্রাণির ডাক । এরই ফাকে চুকিয়ে নিলাম রাতের খাবারের পাঠ । গান , কৌতুক , অভিনয় এসবও চলল । একসময় থেমে গেল ' এমভি যাত্রা’র একটানা গর্জন । আমরাও ঘুমিয়ে পড়লাম ।
২২ এপ্রিল , বুধবার ২০২১
সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে । জেগে দেখি লঞ এগিয়ে যাচ্ছে পানি কেটে কেটে । সকাল বেলার সােনা রােদ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে । গাছের ফাকে ফাকে এক অপরুপ আলোছায়ার ইন্দ্রজাল । একফাকে নাশতা সেরে নিলাম । যত এগুচ্ছি ততই দেখছি বনের অপূর্ব শােভা । ডালে ডালে নেচে বেড়াচ্ছে বাদর । মাঝে মাঝে চোখে পড়ল চর বা দ্বীপ । সাব্বির ভাই জানালেন , সুন্দরবনে জালের মতাে ছড়িয়ে রয়েছে নদী আর খাল । অধিকাংশই শাখানদী । আর দ্বীপের ঘন জঙ্গলে রয়েছে অসংখ্য হরিণ । আর ‘ টাইগার পয়েন্ট , হিরন পয়েন্ট এবং কচিখালি’- এই তিনটি অভয়ারণ্যের তাে তুলনাই নেই ।
বেলা বারােটা ‘ টাইগার পয়েন্টের কাছাকাছি পৌছে গেলাম । এমভি যাত্রা ' নােঙর করল । এর একটানা শব্দ গেল থেমে । আমরা নৌকা করে হারবারে গিয়ে উঠলাম । দূরে ‘ টাইগার পয়েন্টের ফটক । অবশেষে প্রথম পা রাখলাম সুন্দরবনের মাটিতে । মন্ত্রমুগ্ধের মতাে এগিয়ে যাচ্ছি । এমন আনন্দের শিহরণ আগে কখনাে অনুভব করি নি । দু'পাশে সারি সারি গাছপালা , মাঝখানে সরু পথ । রেস্ট হাউসে উঠলাম । সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় রত বন্দুকধারী রক্ষী । খাওয়া - দাওয়া করে রেস্ট হাউস থেকে নেমে পেছনের পুকুর পাড়ে বসে আছি । খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলাে । হঠাৎ দেখতে পেলাম । হরিণের পাল । সবাই নিঃশব্দ রইলাম । পাছে সামান্য শব্দে পালিয়ে যায় । ক্যামেরা রেডিই ছিল । বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নেয়া হলাে অনেক । শাবক হরিণগুলাের সে কী হুটোপুটি ! একটা হরিণের পিঠে দেখলাম এক বানর । শুনেছিলাম , বানরের সাথে হরিণের অপূর্ব মিতালির কথা । আজ নিজ চোখে দেখছি । ভাবছি স্বপ্ন নয় তাে !
এবার অরণ্য দেখার পালা জীতু ভাঙা রেকর্ডের মতাে অনবরত বলে যাচ্ছে , বাঘ দেখব কখন , বাঘ দেখব কখন । বাঘ যে যখন তখন দেখা যায় না একথা ওকে বােঝায় সাধ্যি কার । আহ্ ! চারদিকে কেবুল সবুজ আর সবুজ । সুন্দরি , কেওড়া , গড়ান- এসব গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন সাকির ভাই । দেখলাম অসংখ্য পাখি । বিচিত্র রঙের , বিচিত্র গড়নের । তাদের কলকাকলিতে মুখরিত বনাঞ্চল । আমরা ধীর পায়ে হেঁটে চলেছি । আমাদের চলার শব্দ আর পাখিদের গুঞ্জন ছাড়া কোনাে শব্দ নেই । হঠাৎ আমার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন সরে গেল । আমি মরণপণ চিৎকার করলাম । হাত থেকে ক্যামেরা ছিটকে পড়ল । কাছাকাছি কয়েকটা গাছে পাখিদের পাখা ঝাপটানােও শুনলাম । শেষে যা আবিষ্কৃত হলাে তা দেখে সবার সাথে আমিও হেসে ফেললাম । ওটা ছিল একটা বেজির বাচ্চা ।
যতই চলছি বন ততই গভীর হচ্ছে । এখন আর সূর্যের প্রখর আলাে ভেতরে আসছে না । এই বনের পাশ ঘেঁষেই বঙ্গোপসাগরের শুরু । সেও এক অসাধারণ দৃশ্য । যতই দেখি তৃষ্ণা মেটে না । আরাে গভীরে যাওয়া নিরাপদ ছিল না , আমরা ফিরে এলাম ।
এক পাল হরিণের স্বাধীন বিচরণ দেখলাম বন বিভাগের অবজারভেশন টাওয়ার থেকে । দেখলাম , অসংখ্য হরিণ নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে । মাঝে মাঝে কান খাড়া করে কিছু শােনার চেষ্টা করছে । আমার মনে হচ্ছিল টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখছি । ইচ্ছে হচ্ছিল , এই রাতটা থেকে যাই । আজ পূর্ণিমা । চাদের আলােয় সুন্দরবনকে কী মনােরমই না দেখাবে । কিন্তু উপায় নেই । ফিরতে হবে , ফিরতেই হবে ।
বিকেল গড়িয়ে গেছে । সূর্যের রঙ লাল । বাঘের দেখা পেলাম না । টাইগার না দেখে ‘ টাইগার পয়েন্ট থেকে ফিরে যাব ! খুব খারাপ লাগছিল । একটু পরেই নিসর্গ ঢেকে যাবে আঁধারে । আমরা ফিরে এলাম ' এমভি যাত্রায় সন্ধ্যের আঁধার পেরিয়ে গেলে এমভি যাত্রা’র যাত্রা শুরু হলাে ।