সন্ধি কাকে বলে । সন্ধির শ্রেণীবিভাগ স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গ সন্ধির পার্থক্য | বাংলা ব্যাকরণ
সন্ধি
সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন । পাশাপাশি দু'টি ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে । যেমন- বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয় । এখানে ‘ বিদ্যা ’ শব্দের সাথে “ আলয় ’ শব্দের মিলন ঘটেছে । সুতরাং এ ধরনের ধ্বনির মিলনের নামই সন্ধি ।
সন্ধির উদ্দেশ্য -সন্ধির উদ্দেশ্য হল উচ্চারণ সহজতর করা । যেমন- বিদ্যা ও আলয় ' উচ্চারণে যে আয়াস বা শ্রমের প্রয়ােজন , বিদ্যালয় ' শব্দটি তার চেয়ে অনেক অল্প আয়াসে উচ্চারিত হয় । সন্ধি ভাষাকে সহজতর করে ও উচ্চারণে ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি করে । সুতরাং উচ্চারণে আয়াস ও ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টিই সন্ধির মূল উদ্দেশ্য ।
তবে দু'টি স্বরধ্বনি নিকটবর্তী হলেও যদি পৃথক পৃথক ভাবে উচ্চারিত হয় , তবে সে ক্ষেত্রে সন্ধি হয় না । যেমন- অনুমতি - অনুসারে । আবার শ্রুতিমধুরতাও সন্ধির বিচার্য বিষয় ।
যে দু'টি ধ্বনির মধ্যে সন্ধি হবে , তাদের মধ্যে অবশ্যই পরস্পর সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয় । বিদ্যার সঙ্গে আলয়ের ( আলয় অর্থ আশ্রয় বা স্থান ) সম্পর্ক আছে । সুতরাং এ দু'টির মধ্যে সন্ধি হতে পারে , কিন্তু বিদ্যা + আলু = বিদ্যালু - এরূপ সম্পর্কহীন ধ্বনির সন্ধি হতে পারে না ।
সন্ধি প্রধানতঃ দু ' প্রকার । যথা- ( ১ ) স্বরসন্ধি ও ( ২ ) ব্যঞ্জন সন্ধি ।
স্বরসন্ধি - স্বরবর্ণের সাথে স্বরবর্ণের যে সন্ধি বা মিলন হয় , তাকে স্বরসন্ধি বলে।
ব্যঞ্জন সন্ধি -ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণের বা ব্যঞ্জনবর্ণের যে সন্ধি হয় , তাঁকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে ।
নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি- সন্ধির নিয়ম না মেনে যে সন্ধি হয় , তাকে নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে ।
বিসর্গ সন্ধি - বিসর্গের সাথে স্বরধ্বনি বা ব্যঞ্জন ধ্বনির যে সন্ধি হয় , তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে । বিসর্গ সন্ধি ব্যঞ্জন সন্ধির অন্তর্গত ।
স্বরসন্ধি
১। অ - কার কিংবা আকারের পর অ - কার কিংবা আ - কার থাকলে উভয়ে মিলে আ - কার হয় এবং আ - কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় । যথা-
অ + অ = আ নব + অন্ন = নবান্ন
অ + আ = আ সিংহ + আসন = সিংহাসন
অ + অ = আ যথা + অর্থ = যথার্থ
আ + আ = আ মহা- + আশয় = মহাশয়
এরূপ —নরাধম , হিতাহিত , হিমালয় , দেবালয় , মহা , কারাগার , বিদ্যালয় , রত্নাকর , আশাতীত ইত্যাদি ।
২। অ - কার কিংবা আকারের পর ই - কার কিংবা ঈ - কার থাকলে উভয়ে মিলে এ - কার হয় , এবং এ - কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় । যথা-
১০। উ - কার কিংবা ঊ - কারের পর উ - কার কিংবা ঊ - কার থাকলে উভয়ে মিলে ঊ - কার হয় , এবং ঊ - কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় । যেমন-
উ + উ = ঊ মরু + উদ্যান = মরূদ্যান
ঊ + উ = ঊ কটু + উক্তি = কটুক্তি
ঊ + ঊ = ঊ ভূ- + উর্ধ্ব = ভূর্ধ্ব
১১। উ - কার কিংবা ঊ - কারের পর উ - কার কিংবা ঊ - কার ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণ থাকলে উ বা ঊ - কারের স্থানে "ব্" হয় , এবং ব - ফলা পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় । যেমন-
উ + অ = ব + অ সু + অল্প = স্বল্প
উ + আ = ব + আ সু + আগত = স্বাগত
উ + ঈ = ব + ঈ তনু + ঈ = তন্বী
উ + এ = ব + এ অনু + এষণ = অন্বেষণ
১২। স্বরবর্ণ পরে থাকলে এ স্থানে ' অয় ' , ঐ স্থানে ' আয় ' , ও স্থানে অব " এবং ঐ - স্থানে ‘ আব ' হয় , পরবর্তী স্বরবর্ণ অ ব্য আ - এর সাথে পূর্ববর্তী য় বা ব যুক্ত হয় । যেমন—
৩। ট কিংবা ঠ এর পরে থাকলে ত ও দ এর স্থানে ট হয় এবং ড কিংবা ঢ পরে থাকলে ত ও দ এর স্থানে ড হয় । যেমন-
ত + ট = ট্ট বৃহৎ + টীকা = বৃহট্টীকা
দ + ট =ট্ট তদ্ + টীকা = তট্টীকা
ত + উ = ড্ড উৎ + ডীন = উড্ডীন
ত + ঢ = ড্ঢ তৎ + ঢক্কা = তড্ঢক্কা
৪। ন কিংবা ম পরে থালে পদের অন্তস্থিত বর্গের প্রথম বর্ণস্থানে সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয় । ( অর্থাৎ ক স্থানে ঙ , ত স্থানে ন হয় । ) যেমন-
নিক + নির্ণয় = দিঙনির্ণয় মৃৎ + ময় = মৃন্ময়
বাক + ময় = বাঙময় জগৎ + নাথ = জগন্নাথ
তৎ + ময় = তন্ময় চিৎ + ময় = চিন্ময়
এরূপ— তন্মধ্যে , উন্নীত , তন্মাত্রা , অগ্নিমিত্ত , উন্নয়ন ইত্যাদি ।
৫। ত - কার কিংবা দ – কারের পর ল থাকলে ত ও দ স্থানে ল হয় । যথা-
উৎ + লাস = উল্লাস তদ + লিখিত = তল্লিখিত
উৎ + লেখ = উল্লেখ বিপদ + লাভ = বিপল্লাভ
উৎ + লিখিত = উল্লিখিত
৬। শ পরে থাকলে ত ও দ স্থানে চ এবং শ স্থানে ছ হয় । যেমন-
ত + শ = চ + ছ =চ্ছ উৎ + শ্বাস = উচ্ছ্বাস
ত + শ = চ + ছ = চ্ছ তদ + শ্ৰবণ = তচ্ছ্রবণ
এরূপ - চলচ্ছক্তি , উচ্ছল , আচ্ছান্তি ইত্যাদি ।
৭। হ পরে থাকলে ত ও দ স্থানে দ এবং হ স্থানে ধ হয় । যেমন-
ত + হ = দ + ধ = দ্ধ উৎ + হার = উদ্ধার
দ + হ = দ + ধ = দ্ধ তদ + হিত = তদ্ধিত
এরূপ – উদ্ধত , উদ্ধৃতি , জগদ্ধিত ইত্যাদি ।
৮। স্বরবর্ণের পরে ছ থাকলে ছ এর স্থানে চ্ছ হয় । যেমন-
পরি + ছন্ন = পরিচ্ছন্ন বি + ছেদ = বিচ্ছেদ
পরি + ছেদ = পরিচ্ছেদ তরু + -ছায়া = তরুচ্ছায়
৯। স্বরবর্ণ , বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ণ কিংবা য , র , ল , ব , হ পরে থাকলে বর্গের প্রথম বর্ণ স্থানে সেই বর্গের তৃতীয় বর্ণ হয় । অর্থাৎ ক এর স্থানে গ , চ এর স্থানে জ , ট এর স্থানে ড , ত এর স্থানে দ এবং প এর স্থানে ব হয় । যেমন-
দিক + অন্ত = দিগন্ত জগৎ + বিখ্যাত = জগদ্বিখ্যাত
বাক + ধারা = বাগধারা উৎ + যােগ = উদ্যোগ
ণিচ + অন্ত = ণিজন্ত অপ + জ = অব্জ
ষট + যন্ত্র = ষড়যন্ত্র তৎ + রূপ = তজপ
১০। মূর্ধন্য ষ - এর পরে ত বা থ থাকলে ত এর স্থানে ট ও থ এর স্থানে ঠ হয় । যেমন-
তুষ + ত = তুষ্ট ষষ্ + থ = যষ্ঠ
বৃষ + তি = বৃষ্টি বলিষ + থ = বলিষ্ঠ
১১। য , র , ব কিংবা শ , স বা হ পরে থাকলে ম এর স্থানে অনুস্বর হয় । যেমন-
১২। নাসিকা ধ্বনি ম - এর পর যে কোন বৰ্গীয় ধ্বনি থাকলে ম - ধ্বনিটি সেই বর্গের নাসিকা ধ্বনি হয় । যেমন-
সম + চয় = সঞ্চয় সম + -গীত - সঙ্গীত
সম + তনি = সন্তান সম + কল্প = সঙ্কল্প
এরূপ - সম্মান , সন্ধান , সন্ন্যাস ও সন্দর্শন ইত্যাদি । ব্যতিক্রম : - কিন্তু ত– এর পূর্বে ম থাকলে কেবল ন হয় । যেমন-
কিম্ + তু = কিন্তু গম + তব্য = গন্তব
১৩। বর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় কিংবা দন্ত্য - স পরে থাকলে দ অথবা ধ এর স্থানে ৎ হয় । যেমন-
দ + ত = ত + ত তদ + কাল = তৎকাল
ধ + ত = ত + ত ক্ষুধ + পিপাসা = ক্ষুৎপিপাসা
এরূপ - তৎপর , হৃৎকম্প , তৎসম , বিপৎপাত ইত্যাদি ।
১৪। চ - কার কিংবা জ – কারের পর ন থাকলে ন এর স্থানে ঞ হয় । যেমন-
চ + ন = চ + ঞ যাচ + না = যচঞা
জ + ন = জ + ঞ যজ + ন = যজ্ঞ
জ + ন = জ + ঞ রাজ + নী = রাজ্ঞী
১৫। বিশেষ নিয়মে সাধিত কতকগুলাে সন্ধি । যেমন-
পরি + কার = পরিষ্কার সম + করি = সংস্কার
পরি + কত = পরিষ্কৃত সম + কৃত = সংস্কৃত
উৎ + স্থাপন = উত্থাপন উৎ + স্থান = উত্থান
১৬।নিম্নলিখিত সন্ধিগুলাে নিপাতনে সিদ্ধ অর্থাৎ নিয়ম বহির্ভূত ।যেমন-
আ + চর্য = আশ্চর্য এক + দশ = একাদশ
গো + পদ = গোষ্পদ তৎ + কর = তঙ্কর
বন + পতি = বনস্পতি বৃহৎ + পতি = বৃহস্পতি
পর + পর = পরস্পর মনস্ + ঈষা = মনীষা
ঘট + দশ = ষােড়শ দিব্ + লােক = দ্যুলােক
বিসর্গ সন্ধি
১। চ কিংবা ছ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে শ হয় । যেমন-
নিঃ + চয় = নিশ্চয় শিশ্নঃ + ছেদ = শিরচ্ছেদ
দুঃ + চিন্তা = দুশ্চিন্তা দুঃ + ছেদ্য = দুচ্ছেদ্য
২। ট কিংবা ঠ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে ষ হয় । যেমন –
ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার নিঃ + ঠুর = নিষ্ঠুর
৩। ত কিংবা থ পরে থাকলে বিসর্গ স্থানে স হয় । যেমন-
নিঃ + তার = নিস্তার মনঃ + তাপ = মনস্তাপ
দুঃ + তর = দুস্তর ইতঃ + তত = ইতস্তত
বিঃ + তার =বিস্তার দুঃ + থ = দুস্থ
৪। ক , খ , প , ফ পরে থাকলে অ - কার কিংবা আ-কারের পরস্থিত বিসর্গ স্থানে স হয় এবং অন্য স্বরের পরস্থিত বিসর্গ স্থানে ষ হয় । যেমন-
পুরঃ + কার = পুরস্কার আবিঃ + কার = আবিষ্কার নমঃ + করি = নমস্কার নিঃ + ফল — নিষ্ফল
ভাঃ + কর = ভাস্কর নিঃ + পাপ — নিষ্পাপ
৫। বর্গের তৃতীয় , চতুর্থ , পঞ্চম বর্ণ কিংবা য , র , ল , ব , হ পরে থাকলে পূর্ববর্তী অ - কার ও তৎপরবর্তী বিসর্গ উভয়ে মিলে ও - কার হয় , এবং ও - কার পূর্ব বর্ণে যুক্ত হয় । যেমন-
তিরঃ + ধান = তিরােধান পুরঃ + হিত = পুরােহিত
মনঃ + রম = মনােরম সরঃ + বর = সরোবর
মনঃ + যােগ = মনােযােগ মনঃ + হর = মনােহর
৬। স্বরবর্ণ , বর্গের তৃতীয় , চতুর্থ , পঞ্চম বর্ণ কিংবা য , র , ল , ব , হ পরে থাকলে অ , আ ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণের পরস্থিত বিসর্গ স্থানে র হয় । যেমন-
নিঃ + ভয় = নির্ভক্স অন্তঃ + গত = অন্তর্গত
দুঃ + নাম = দুর্নাম দুঃ + গতি = দুর্গতি
৭। র - পরে থাকলে অ , আ ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণের পরবর্তী বিসর্গ স্থানে যে বর্ণ হয় , তা লােপ পায় এবং পূর্বের হ্রস্বস্বর দীর্ঘস্বর হয় । যেমন—
নিঃ + রােগ = নীরােগ নিঃ + রস = নীরস
নিঃ + রব — নীরব চক্ষুঃ + রােগ = চক্ষুরােগ
৮। অ - কার ভিন্ন অন্য স্বর পরে থাকলে কেবল বিসর্গের লােপ হয় এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্বরধ্বনি অবিকৃত বা অবিকল থাকে । যেমন-
১০। যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি স্ত , স্থ , স্প ইত্যাদি থাকলে বিসর্গ অবিকৃত থাকে বা লােপ হয় । যেমন —
নিঃ + স্তব্ধ = নিঃস্তব্ধ বা নিস্তব্ধ , নিঃ + স্পন্দ = নিঃস্পন্দ বা নিস্পন্দ ।
বিঃ দ্রঃ - আজকাল বাংলা বানানে অনেক ক্ষেত্রে বিসর্গ ব্যবহার না করার প্রবণতা দেখা যায় । যেমন — ইতস্তত , আপাতত , প্রধানত , বস্তুত , মূলত , সাধারণত , দুস্থ ইত্যাদি ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন